মলদ্বারে ভয়ঙ্কর রোগ- চিকিৎসা বিজ্ঞানের আদি থেকেই এ রোগটি চিকিৎসকদের কাছে পরিচিত। এ রোগে রোগীর পায়ুপথ মলদ্বারের বাইরে বেরিয়ে আসে। বিশেষত পায়খানা করার সময় বাইরে ঝুলে পড়ে। এরপর রোগী হাত দিয়ে এটিকে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। দেশের বিভিন্ন এলাকার রোগীরা এটিকে ভিন্ন ভিন্ন নামে যেমন- সিলেটে বলে আলিশ, হবিগঞ্জ এলাকায় বলে কম্বল বের হয়েছে এবং বরিশালের লোকেরা বলে আইলতা বের হয়েছে।
কেন হয়?
এ রোগটি শিশু ও বৃদ্ধ বয়সে বেশি হয়। মহিলাদের হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। শিশুদের সাধারণত তীব্র ডায়রিয়ার পর এ রোগ দেখা দেয়। তলপেটের বা পেলাভিসের কিছু গঠনগত সমস্যা এ রোগের জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় পায়ুপথ বা রেকটাম অন্যান্য মাংসপেশির সাথে আঁকড়ে থাকে। কিন্তু এ রোগীদের ক্ষেত্রে এর অভাব দেখা যায়। এ রোগে বিভিন্ন কারণের মধ্যে রয়েছে মলত্যাগের অভ্যাসের অসঙ্গতি যেমন- কোষ্ঠকাঠিন্য, মহিলাদের বন্ধ্যাত্ব, রেকটামের সাথে সন্নিহিত অস্থির দৃঢ় সংযুক্তির অভাব ইত্যাদি। মানসিক রোগীদের মধ্যে এ রোগ বেশি দেখা যায়। জগদ্বিখ্যাত পায়ুপথ বিশেষজ্ঞ ডা: গলিঘারের মতে, তার দেখা রোগীদের এক-তৃতীয়াংশই মানসিক রোগী।
উপসর্গ :
রোগীরা সাধারণত অভিযোগ করেন, তাদের মলদ্বার পায়খানা করার সময় অনেকখানি নিচে ঝুলে পড়ে এবং চাপ না দিলে ভেতরে যায় না। ওজন তুললে অথবা কাশি দিলেও কখনো কখনো বেরিয়ে আসে। সাধারণত রক্ত যায় না, তবে মিউকাস বা আম যায়। যখন পায়ুপথ বেশি ঝুলে পড়ে এবং ঢুকানো যায় না তখন রক্ত যেতে পারে। প্রায় অর্ধেক রোগী কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগেন।
অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের রোগী পায়খানা আটকে রাখতে ব্যর্থ হয়। কখনো কখনো ঝুলে পড়া অংশ চেষ্টা করেও ভেতরে ঢুকানো যায় না, অবস্থা আরো খারাপ হলে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে পচন ধরতে পারে। মহিলাদের ক্ষেত্রে এর সাথে জরায়ুও বেরিয়ে আসতে পারে এবং মূত্রথলিও ঝুলে পড়তে পারে, যার কারণে প্রস্রাবের অসুবিধা হতে পারে।
এ রোগের শুরুতে রোগীরা বলেন, তাদের মনে হয় পায়ুপথ ভরা ভরা লাগে এবং ভেতরে কোনো চাকা বা মাংসের দলা রয়েছে বলে মনে হয়। অনেকক্ষণ বসে বা দাঁড়িয়ে থাকলে সমস্যা আরো বেশি মনে হয়। মলত্যাগ করতে বা বায়ু ত্যাগ করতে কিছুটা বাধা লাগে। পায়খানা করার পর পেট ক্লিয়ার হয়নি বলে মনে হয় এবং আঙুল দিয়ে পায়খানা করতে হয়। কারো কারো মলদ্বারের চতুর্দিকে ব্যথা হয় যা নিতম্ব অথবা পায়ের দিকে বিস্তৃত হতে পারে।
চিকিৎসা :
প্রোল্যাপস দুই ধরনের হতে পারে। আংশিক যে ক্ষেত্রে মিউকাস ঝিল্লি ঝুলে পড়ে এবং সম্পূর্ণ সে ক্ষেত্রে পায়ুপথের প্রাচীরের সব স্তরসহ ঝুলে পড়ে। প্রোল্যাপস যে প্রকারেরই হোক এর চিকিৎসা অপারেশন। তবে কোনো রোগী যদি চিকিৎসার জন্য অনুপযুক্ত বিবেচিত হন বা অপারেশন করতে রাজি না হন, তাহলে কিছু রক্ষণশীল পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়। যেমন- মলত্যাগের সময় মলদ্বার হাত দিয়ে চেপে উপরের দিকে রাখতে হয়, নিতম্ব দুটিকে টেপ দিয়ে আটকে রাখা, মলদ্বারের মাংসপেশির ব্যায়াম, রিং লাইগেশন পদ্ধতি ইত্যাদি।
অপারেশন পদ্ধতি :
এ রোগের চিকিৎসায় ৫০ ধরনের অপারেশন পদ্ধতি চালু রয়েছে। কোনো কোনোটি মলদ্বারে করতে হয় আবার কোনো কোনোটি পেট কেটে করতে হয়। এ রোগটি নিয়ে সমাজে ভ্রান্ত ধারণা ও বিভিন্ন কুসংস্কার রয়েছে। নরসিংদী থেকে আসা ১২ বছরের এক ছেলের এ রোগ ছিল। তার মলদ্বারে ছোট একটি অপারেশন করলে সে ভালো হয়ে যায়। বেশ কিছুদিন পর তার মা (৩৩ বছর) আমার কাছে আসেন এবং বলেন, তারও একই রোগ রয়েছে গত ১২ বছর ধরে। মলত্যাগের পর পায়ুপথ বেরিয়ে আসত। এরপর চাপ দিলে ভেতরে ঢুকে যেত। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এতদিন কেন চিকিৎসা করাননি?
উত্তরে তিনি বলেন, তিনি এটিকে স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করেছেন এবং ভেবেছেন এর কোনো চিকিৎসা নেই। তার ছেলের একই রোগের যখন চিকিৎসা হলো এবং সে সম্পূর্ণ ভালো হয়ে গেল, তখন মা ভাবলেন- এর সঠিক চিকিৎসা আছে। পরে আরো আশ্চর্য হলাম। জিজ্ঞেস করলাম, সাথে আসা ভদ্রলোকটি কে? তিনি বললেন, তার ভাই। স্বামী কেন আসেনি জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, তিনি এ ব্যাপারটি জানেন না। আমি বললাম, আপনার ১২ বছর ধরে এই সমস্যা, কেন তাকে জানাননি? তিনি বললেন, স্বামীকে জানালে তিনি খারাপ ভাববেন। তাই কখনো জানাতে চাইনি। এরপর তার মলদ্বারে অপারেশন করায় ভালো রয়েছেন।
উল্লেখ্য, এই মহিলা মাঝে মধ্যেই দিনে ৮-১০ বার পায়খানা করতেন। এ রোগটিকে বলে ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রম বা অতিরিক্ত সংবেদনশীল আন্ত্রিক জটিলতা। একই সাথে পেটের এই দীর্ঘস্থায়ী আমাশয়ের চিকিৎসায়ও তিনি উপকৃত হয়েছেন।
মতামত :
বিগত নয় বছরে ২৯ হাজার ৬৩৫ জন রোগীর ওপর গবেষণা করে দেখেছি, যার শতকরা এক ভাগ রোগী রেকটাল প্রোল্যাপস রোগে ভুগছেন। এসব রোগীদের কেউ কেউ এক থেকে ৩০ বছর ধরে এ সমস্যায় ভুগছেন। এ ক্ষেত্রে পায়খানা করার সময় মলদ্বার বাইরে বেরিয়ে আসে। মলত্যাগের পর রোগী চাপ দিয়ে এটি ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। এতে সাধারণত রক্ত যায় না। মিউকাস বা আমজাতীয় নিঃসরণ হয় মলদ্বারের আশপাশে। মলদ্বার ভেজা ভেজা থাকতে পারে, কখনো কখনো বের হওয়া মলদ্বার ভেতরে ঢুকানো যায় না, তখন বেশ ব্যথা হয় এবং জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করতে হয়।
এ রোগে এ পর্যন্ত যাদের অপারেশন করেছি তাদের দুইজন ভালো হননি এবং একজন বয়স্ক রোগী মারা গেছেন। এ রোগীর মলদ্বার বাইরে বের হলে আর ঢুকানো যায়নি। যে কারণে সেখানে গ্যাংগ্রিন বা পচন ধরে যায়। পচন ধরা মলদ্বার কেটে ফেলার পরও তার অবস্থার উন্নতি হয়নি। এ রোগী প্রায় ৩০ বছর ধরে এ রোগে ভুগছিলেন। কিন্তু তীব্র সমস্যা না থাকায় তিনি অবহেলা করেছেন। অবস্থা যখন তীব্র আকার ধারণ করে মলদ্বার ভেতরে ঢুকাতে পারেননি এবং মলদ্বার পচন ধরে যায়। তখন তিনি চিকিৎসার জন্য আসেন। ইতোমধ্যে আমরা এ রোগের জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উন্নতমানের চিকিৎসা শুরু করেছি। এটি মলদ্বার দিয়ে করা হয়। পেট কাটা লাগে না। এই বিশেষ ধরনের অপারেশনের ফলে ৮০ শতাংশ রোগী সম্পূর্ণ ভালো হয়েছেন।
লেখক : বৃহদন্ত্র ও পায়ুপথ বিশেষজ্ঞ, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, (অব) কলোরেকটাল সার্জারী বিভাগ, বিএসএমএমইউ, ঢাকা।